ফাটাপুকুর একটি পুকুরের নাম। সেই থেকেই এলাকারও নাম ফাটাপুকুর। জলপাইগুড়ি জেলার রাজগঞ্জ বিধানসভার অন্তর্গত পানিকাউরি অঞ্চলে অবস্থিত এই এলাকা। পানিকাউরি গ্রাম পঞ্চায়েতের কার্যালয় ফাটাপুকুরেই অবস্থিত। শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি জাতীয় সড়কের পাশে অবস্থিত একটি প্রকাণ্ড দীঘির নামে এলাকার নাম ফাটাপুকুর (Fatapukur)।
ফাটাপুকুর নাম কেন?
ফাটাপুকুর নাম শুনেই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, এই পুকুর কি ফেটে তৈরি হয়েছিল? স্থানীয়দের অনেকেই বলেন, বড় কোনও ভূমিকম্পে মাটি ফেটে পুকুর তৈরি হয়। অনেকের ধারনা প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি ফাটলকে কেন্দ্র করে দীঘি খনন করা হয়। যদিও এমন দাবির সাপেক্ষে কোনও প্রমাণ মেলে না।
ফাটাপুকুর নামকরণের ইতিহাস নিয়েও বিস্তারিত কোনও লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে ইতিহাসবিদরা মনে করেন কোনও রাজার আমলে এই পুকুর খনন করা হয়েছিল। জলপাইগুড়ির ইতিহাস গবেষক উমেশ শর্মা এই ব্যাপারে কিছু সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, এই দীঘি অনেক পুরনো। পাশাপাশি রাজ্যগুলির মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কায় অনেক সময় বিস্তৃত ফাঁকা মাঠের মাঝখানে এরকম পুকুর কয়েক মাইল পরপর খনন করা হত। সেই পুকুরে সেনার যাতায়াত এবং গোপনে থাকার ব্যবস্থা ছিল। চারদিক থেকে প্রবেশ পথ তৈরি করা হত। পরে সেই পথগুলি অতিরিক্ত জল বের হওয়ার রাস্তা হয়ে দাঁড়ায়। ওই দীঘির দক্ষিণ দিকে অতিরিক্ত জল বের করার জন্য পাড় কেটে দেওয়া হত। সেই কাটা থেকে ‘কাটাপুকুর’, তা থেকে ফাটাপুকুর নাম হতে পারে। উমেশ বাবু, পৃথু রায়ের সঙ্গে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজীর যুদ্ধের কথাও উল্লেখ করেছেন। সেই সময়ে ফাটাপুকুরের সঙ্গে সঙ্গে রাজগঞ্জের আরও কয়েকটি পুকুর (যেমন বলদিয়াপুকুর) দীঘিগুলি তৈরি করা হতে পারে। তবে এই ব্যাপারে উমেশ বাবু স্পষ্ট জানান, তাঁর কাছে কোনও লিখিত তথ্য নেই। প্রবীণ স্থানীয়দের একাংশের দাবি, অনেকেই স্নান করতে নেমে পুরনো সান বাঁধানো ইট প্রত্যক্ষ করেছেন।
ফাটাপুকুর সারদামনি হাইস্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক সুমন রায় দাবি করেন, ১৮০০ সাল থেকে ১৮৪৭, এই সময়ের মধ্যে বৈকুণ্ঠপুরের তৎকালীন রাজা সর্বদেব রায়কত এই পুকুরগুলি খনন করেছিলেন। তৎকালীন দিনাজপুরের বাসিন্দা জিয়ন গোমস্তা পুকুর খোঁড়ার কাজের ঠিকাদার ছিলেন। মূলত স্থানীয় পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে দীঘি খোঁড়া হয়েছিল। পুকুর খনন করার পর প্রতি বর্ষায় জল উপচে পড়তে বলে দাবি। সে কারণে পুকুরের দক্ষিণ দিকে কিছুটা ফাঁকা রাখা হয়েছিল। সেই থেকে প্রথমে ‘কাটাপুকুর’ বলা হত। পরে সেখান থেকে ফাটাপুকুর নাম হয়েছে। এই সংক্রান্ত পুরনো লেখা প্রসঙ্গে সুমন রায় একটি বইয়ের হদিস দেন। দেশ স্বাধীনতার পর উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বিভাগের বিভাগীয় সচিব হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘উদবাস্তু’ নামের বইটির ১৯ পাতায় ফাটাপুকুরের নাম ‘ফাটাপুকুরি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে লেখা রয়েছে, দীঘির পাড় ‘প্রায় ২০ ফুট মত উচু’ করে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। ‘চারপাশ ঘিরে যে বাঁধ রয়েছে, তার একটি অংশে ফাঁক ছিল বলে নাম ‘ফাটাপুকুরি’ হয়েছে।
ফাটাপুকুর এলাকার পুরনো বাসিন্দাদের দাবি, ওই পুকুরে দেবী চৌধুরানী আনাগোনা ছিল। এখনও খুঁজলে ‘সন্ন্যাসী স্থান’ পাওয়া যায়। পুকুরের পূর্ব পাশে সেই সাক্ষ্য বহনকারী বটগাছ দুটির একটি কয়েক বছর আগে ভেঙে পড়েছে বলে দাবি। আরও বলা হয়, ওই পুকুরে কিছু চেয়ে লিখে জলে ফেললে পরদিন কাঙ্খিত জিনিস ভেসে আসত। যদিও এসব গল্প কথা বলেই দাবি করেন ইতিহাসবিদরা। এছাড়াও নানা জনশ্রুতি এবং কল্পনা কথা রয়েছে ওই দীঘিকে কেন্দ্র করে। এলাকার অনেক বয়স্ক মানুষ ‘ফাটাপুকুরি’ বা ‘ফাটাপোখোরি’ বলেই জানতেন। কয়েকজন ‘ফেটে পুকুর হয়েছে’ দাবি করলেও বেশিরভাগ মানুষ পুকুর খননের ব্যাপারেই বিশ্বাস প্রকাশ করেছেন।
তথ্য সংগ্রহ এবং লেখনি: দেবজিৎ সরকার, ফাটাপুকুরের বাসিন্দা এবং আরএনএফ নিউজ-এর সম্পাদক।