লেখক পরিচিতি: রাজগঞ্জ সুভাষপল্লীর বাসিন্দা তাপস কুমার রায়, অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় যুবক। রাজগঞ্জ ইভোলিউশন ফাউন্ডেশন সংস্থার হয়ে ২০১১ সালে দলগতভাবে করতোয়া নদীর উৎস খুঁঁজতে অভিযান করেন। সেই যাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে গত ৭ মার্চ, ২০১৭ সালে ‘করতোয়ার উৎস সন্ধানে’ লেখাটি প্রকাশ করেন। লেখাটি সামান্য পরিবর্তন করে নিয়ে নিম্নলিখিতভাবে তুলে ধরা হল।
তাপস কুমার রায়, রাজগঞ্জ: করতোয়া, ঐতিহাসিক এই নদীটিকে রাজগঞ্জ ব্লকের প্রাণের উৎস বলা হলে ভুল কিছু বলা হবে না। রাজগঞ্জের ইতিহাস, ভূগোল তথা ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে করতোয়া নদী। তাই আমরাও নিজেদের অভিযাত্রী মনকে আবদ্ধ রাখতে পারিনি। নদীটির বর্তমান উৎস কোথায়? এর উত্তর খুঁজতে হন্যে হয়ে ঘুরেছি চারপাশ। কিন্তু কোনও সদর্থক উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না।
ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, ১৮৮৭ সালেরও আগে করতোয়া নদী তিস্তারই অংশ ছিল। তিস্তা অর্থাৎ ‘ত্রি-স্রোতা’, এর পশ্চিম স্রোতটি হল করতোয়া। মাঝেরটি আত্রেয়ী এবং পূর্ব স্রোতটি হল পূর্নভবা। এই তিনটি নদীর মিলিত স্রোতই ছিল প্রাচীন তিস্তার স্বরুপ। কিন্তু ১৮৮৭ সালের ভয়ানক বন্যায় তিস্তার বর্ধিত জলরাশি তার নদীবক্ষে ধরে রাখতে পারেনি। ফলে তিস্তা নিজের প্রাচীন গতিপথ পরিবর্তন করে অনেকটা পূর্বদিকে সরে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে পড়েছে।
ফলে করতোয়া নদীটি একাকি এবং আকারেও অনেকটাই সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। তাই আমরা, ইভোলিউশন ফাউন্ডেশনের সদস্যেরা নদীটির বর্তমান উৎস ও অবস্থার সরজমিনে সমীক্ষা ও পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। একদিন বিকেলে কালিনগর ব্রীজের ওপর এক মিটিংয়ে ঠিক হল করতোয়ার উৎস সন্ধানে বের হচ্ছি আমরা। সকলেই এবিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, ‘করতোয়ার উৎস না দেখে কেউ ফিরছি না।’
যাহোক, বহু আলোচনা ও পরিকল্পনার পর, অজানাকে জানার লক্ষ্যে নভেম্বরের এক শীতভোরে আমরা ১৫ জনের অভিযাত্রী দল বেরিয়ে পড়লাম নতুন অভিযানে। প্রথমে বনদপ্তরের গাড়িতে করে পৌঁছলাম বৈকুন্ঠপুর বনাঞ্চলের চাঁদেরভিটা দিল্লিখালের ঐতিহাসিক ও বিখ্যাত ভবানী পাঠক-দেবী চৌধুরানীর বনদূর্গা মন্দিরে। আমরা সবাই মা বনদূর্গার পুজো দিয়ে পশ্চিমদিক ধরে এগিয়ে সোজা নেমে পড়লাম করতোয়ার বুকে।
উত্তরদিক বরাবর ক্রমাগত স্রোতের বিপরীতে সে এক অমানুষিক কষ্টকর পদযাত্রা। প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের রীতিমত এক লড়াই যেন। এই লড়াইয়ে কখনও আমরা এগিয়ে থাকি কখনও মা করতোয়া। তাই দুর্ভেদ্য জল-জঙ্গলের বেড়াজাল থেকে বাঁচতে কখনও নদীবক্ষ ছেড়ে হাটছি পারিপার্শ্বিক বন পাকদণ্ডিতে। বনজলতার কণ্টকে রক্তাক্ত আমাদের শরীর স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘জিততে হলে রক্ত ঘাম ঝড়াতেই হবে সকলকে।’
কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় হেঁটেছি মাত্র ৪ মাইল পথ। পারিপার্শ্বিক নদীভাঙ্গন দেখে বোঝাই যায় প্রাচীন করতোয়ার বিশাল চণ্ডীরূপ। বুঝতে পারি কেন বৈদেশিক শক্তি যুগযুগ ধরে পশ্চিম থেকে তোমার পূর্বতীরে আসতে পারেনি। কারণ তুমি তোমার গৌরবময় দিনে যে অজেয় ছিলে। এভাবে আরও উত্তরদিকে নদীর সঙ্গে চলেছি আমরা। পথে পড়ে ভগ্নপ্রায় ফাপরি সেতু।
এর আগে মানবহীন দুর্ভেদ্য প্রাচীণ বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল। যেখানে সেখানে পরে রয়েছে হাতি ও হিংস্র শ্বাপদদের পদচিহ্ন। দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে বন্যশূকরের দল। সরীসৃপ ও উভচরদের আকারও বেশ বড়। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল, ক্ষিদে মেটাতে কিছু নদীয়ালি মাছ শিকার করা হল। আদিমতম পদ্ধতিতে আগুনে ঝলসে নেওয়া হল। ক্ষিদের জ্বালায় ঝলসানো মাছগুলোই যেন অমৃত সমান।
এদিকে সূর্য প্রায় অস্তাচলে। সিদ্ধান্ত হল আজকের মত এখানেই বিশ্রাম। সকলেই ক্ষুধার্ত ও পরিশ্রান্ত। তবে রাত্রিকালীন ক্যাম্প করার জন্য মোটেই সুবিধার নয় এই প্রাচীন অরণ্য; একদিকে উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বেশী হাতির গতিবিধি রয়েছে এই অরণ্যে, তারসঙ্গে পারিপার্শ্বিক গাছগুলি থেকে যখন তখন ঝাপিয়ে পড়তে পারে চিতাবাঘ। তাই সেখানে না থেমে আবার নদীর পশ্চিমতীর বরাবর আধঘন্টা হাঁটার পর আশ্রয় পেলাম বিকাশনগর রেঞ্জ অফিসে।
রাতে কোনওরকমে খিচুড়ি তৈরী করে পরের দিনের প্ল্যান ঠিক করতে লেগে পড়লাম আমরা। কারণ পরের দিনের অভিযান যে আরও ভয়ানক হবে তা আমরা আজই আন্দাজ করতে পেরেছি। পদে পদে বন্যপ্রানী আক্রমনের সম্ভাবনা থাকলেও ঘুমোনোর আগে ১৫ জনের মুষ্টিবদ্ধ হাতে সিদ্ধান্ত হল যাইহোক না কেন, করতোয়ার উৎস বিন্দুতে পৌঁছেই বাড়ি ফিরব আমরা।
তবে সে রাতে আর খুব একটা ঘুম হল না কারও। রাতে বিশাল হাতির দল তাদের উপস্থিতি জানান দিতে হানা দিল রেঞ্জ অফিস চত্বরে। বনকর্মীদের সঙ্গে আমরাও হাতি তাড়াতে জাগলাম সারারাত। মনে মনে নিজেদের সিদ্ধান্তের তারিফও করলাম, কারণ সেদিন জঙ্গলেই ক্যাম্প করে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে হয়ত অনেকেই বেঁচে ফিরতনা। পরদিন ভোরে আবার যাত্রা শুরু হল।
এপথে মানুষের কোনও পদচিহ্ন নেই বললেই চলে। বৃক্ষগুলির বিশাল আকার এই জঙ্গলের প্রাচীনতাকে মনে করিয়ে দেয়। গাছের শেকড়গুলিও যেন বিশাল ময়াল আকার রূপধারন করে আমাদের গিলতে প্রস্তুত। কোটরগুলোতে যেন একটু আগেই আশ্রয় নিয়েছিল চিতাবাঘ। ঝোপঝাড় নাড়িয়ে মাঝে মাঝেই নানা প্রজাতির সর্পকুল তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।
তবে এবার আমাদের আত্মবিশ্বাস দেখে মা করতোয়াও যেন উৎসাহিত করছে আমাদের। পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে দৌড়ে পালাচ্ছে ময়ূর, বনমোরগ। কাঠবিড়ালি আর বাঁদরেরাও নদীবক্ষে আমলকি ফেলছে। একটি হরিণ শাবকও যেন এসেছে আমাদের বেস্ট অফ লাক জানাতে। এদিকে বেলা প্রায় দুপুর। হঠাৎ যেন মুচকি হেসে করতোয়া দু’ভাগে ভাগ বিভক্ত হয়ে পড়ল (তথ্য ঘেটে জানা যায় এক অংশের নাম হাড়িয়া ও অন্যটি করতু)।
যাহোক, আমরা অনেক মত বিনিময়ের পর অপেক্ষাকৃত চওড়া উত্তর পূর্বের করতু স্রোতটির সঙ্গে এগোতে থাকলাম। কিন্তু এ কি! কিছুদুর এগোতেই এই ঝোরাটিও আবার দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল (আমাদের দলের দুই সদস্য তথা দুই ভাই লব ও কুশের নামে আমরা এই দুটি ঝোরার নামকরন করলাম, লব ও কুশঝোরা)। করতোয়া যেন আমাদের দিকভ্রান্ত করতে এক মায়াজাল রচনা করেছে।
করতোয়া অর্থাৎ ‘কর+তোয়া’; পুরাণে লিখিত রয়েছে ভগবান শিব ও দেবী পার্বতীর বিয়ের লগ্নে ভগবান শিবের হাতের জল (তোয়া) থেকে এই প্রাচীণ নদীর সৃষ্টি হয়। তাই আমাদের এক সদস্য বলে উঠল, ‘ঝোরাগুলো সত্যি তো মহাদেবের হস্তঅঙ্গুলির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। তাহলে কি মহাদেব আমাদের মত এই অধমদের দেখা দেবেন!’ যাহোক, আমরা কুশ ঝোরা বরাবর এগোতে থাকলাম। জল বলতে কোথাও কোথাও শুধু এক পায়ের পাতা চওড়া আর শুধু বালি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গলের ভূগর্ভস্থ অন্তরালে হারিয়ে গেল ঝোরাটি। পাশে জানিনা কিভাবে হঠাৎ এই গভীর জঙ্গলে একজন মহিলার উদয়। তিনি স্থানীয় ভাষায় বললেন, ‘তোমা কি এইঠে মরিবার তানে আইচ্চেন? জানেননা সামনত ঠাকুর আছে (বনাঞ্চলের অধিবাসীরা সাধারনত হাতিকেই ঠাকুর বলে সম্বোধন করেন।) মহিলার পুরো কথার মানে দাঁড়াল, ‘তোমরা কি এখানে মরতে এসেছ? জানোনা, এখানে হাতি রয়েছে। আজও ভাবি ওই নারী কি সত্যি একজন মানবী ছিলেন না দেবী পার্বতী স্বয়ং নিজেই নারীরূপে এসেছিলেন।
যাহোক, আমাদের মত অধমদের কি আর মহাদেবের সাক্ষাৎ জোটে? তাই বোধহয় মা পার্বতী নারীরূপের মায়াজাল ধারণ করে নদীর যে শেষ আমাদের দেখিয়ে দিলেন তা হয়তো আদতেও নদীটির সূচনা বিন্দু নয়। কিন্তু আমরাও নাছোড়বান্দা দামাল ছেলের দল। এতদিনের এত পরিশ্রম, তথ্য বিশ্লেষণ করে করতোয়া নদীর এরকম সাদামাটা উৎস হবে মেনে নিতে পারিনি আমরা। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। বোতলের জল কবেই শেষ। অগত্যা বালি খুড়ে সঞ্চিত নদীর জল বের করতে হল। খাবারের ভাণ্ডারও খালি হয়ে এসেছে। তবুও হার মানেনি আমাদের অদম্য জেদ।
কবি সুকান্তের কথায়, ‘আঠারো বছর জানেনা মানা।’ বনজ চালতা আর চিনি দিয়েই সাড়লাম দুপুরের লাঞ্চ। আবারও যাত্রা শুরু। এবার পিছিয়ে এসে সেই হাড়িয়া স্রোতটি বরাবর অভিযান শুরু হল। কিন্তু আবার সেই একইভাবে বিভক্ত হাড়িয়াও। একদল দাঁড়িয়ে রইল সংযোগস্থলে। বাকি ৩ সদস্যের দল উত্তর-পূর্ব বরাবর এগিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে জানাল, সামনে গিয়েই হারিয়ে গিয়েছে ঝোরাটি। বারংবার মনে হচ্ছিল, পান্ডব-বর্জিত স্থান বলে মা করতোয়াও কি তার পূর্বতীরটিকে অবহেলার চোখেই দেখে!
এদিকে হাড়িয়ার উত্তরাংশটি তখনও এগিয়ে চলছে। হঠাৎ গহীন অরণ্যের মাঝে দেখতে পেলাম একটি জলাশয়। সম্ভবত এর কথা আমরা এক শতোর্ধ প্রবীণ ব্যক্তির মুখে শুনেছিলাম। আমাদের মনে আর কোনও সন্দেহ রইলনা যে করতোয়ার নদীর উৎসবিন্দু বনাঞ্চলের উদ্ভিদ মূলত্র জলরাশি সঞ্চিত এই জলাশয়টিই। সব ভুলে ঝাপিয়ে পড়লাম এর শীতল জলরাশির বুকে। হয়তো এভারেস্ট জয়ের মত বা চাঁদের পাহাড়ে হীরের খনি খোঁজার মত ততটা দূর্গম ছিলনা এই অভিযান কিন্তু তার থেকে কিছু কমও তো নয় আমাদের কাছে। তাছাড়া, নতুন কিছু খোঁজ করার আনন্দ খোঁজকারী অভিযাত্রী ছাড়া অন্য কারও পক্ষেই সঠিকভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
জলাশয়ে নেমেই সেসময় আমরা যেন এক একজন কলম্বাস, ভাস্কোদাগামা, মার্কোপোলো বা চাঁদের পাহাড়ের সেই দামাল ছেলে শংকর হয়ে উঠেছি। কাছেই গাছগুলোর ফাকফোকড় দিয়ে দৃশ্যমান পাহাড়গুলি অনেকটা নটরাজ রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন। আমরা যেন ভেসে বেড়াচ্ছি তারই হস্ততালুতে। পুরাণে কথিত রয়েছে, ‘গঙ্গা বারবার, করতোয়া একবার।’ তবুও আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, অনাবিল এই সৌন্দর্যের টানে করতোয়ার বুকে ফিরে আসব বারবার। অনেকটা কবি জীবনানন্দের কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে এই শেষ লাইন লিখলাম, ‘আবার আসিব ফিরে, করোতোয়ার তীরে, এই উত্তরবাংলায়।’