দেবজিৎ সরকার, RNF সম্পাদক: বেলাকোবা ট্রেন বিস্ফোরণের পর কেটে গিয়েছে ১৫টা বছর। এখনও সেই সন্ধ্যার কথা মনে করলে শিউরে ওঠেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
দিনটা ছিল সোমবার, ২০ তারিখ। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসের একটি কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যা। ডাউন হলদিবাড়ি-এনজেপি প্যাসেঞ্জার ট্রেন ২০ মিনিট দেরিতে চলছিল। বেলাকোবা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ঘড়িতে সময় তখন ৬টা বেজে ১৯ মিনিট। স্টেশনে এসে দাঁড়াল নিউ জলপাইগুড়িগামী প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি। তারপর মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত; আচমকাই বিস্ফোরণের তীব্র আওয়াজে কেঁপে উঠল স্টেশন চত্বর। চারিদিকে তখন উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি। মানুষের ‘বাঁচাও-বাঁচাও’ চিৎকার ও কান্নার আওয়াজে নিমিষেই নিস্তব্ধ স্টেশন চত্বর হাজার ভিড়ের উৎকণ্ঠার আওয়াজে ভেসে গেল যেন।
ঘটনার পর আহতদের উদ্ধার করতে সবার আগে এগিয়ে আসেন এলাকাবাসীরা। স্টেশনে তখন ধোঁওয়াটে পরিবেশ। অন্ধকার কামরা থেকে আহতদের উদ্ধার করে একটি ট্রাকে করে হাসপাতালে পৌঁছানোর কাজ শুরু হয়। অনেক পরে সেখানে গিয়ে উদ্ধারকাজে হাত লাগায় রেল পুলিশ বাহিনী। সেখানে ছিলেন স্টেশন কলোনির বাসিন্দা মৃত্যুঞ্জয় সেনগুপ্ত। তাঁর কথায়, ‘একটি গোবরের গাড়ি পরিস্কার করে তাতে করে হাসপাতালে রোগী পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।’ সময় গড়ালে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতাল এবং উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হতাহতদের পরিবার ভিড় করতে শুরু করেন।
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সেই সন্ধ্যায় বেলাকোবা স্টেশনে ট্রেনটি থামার কিছুক্ষন পর ইঞ্জিন পরবর্তী ৫ নম্বর বগিতে বিস্ফোরণটি হয়। সেই বগিতে টয়লেট লাগোয়া একটি সবজির বস্তায় বিস্ফোরক রাখা ছিল। তদন্তে উঠে আসে এই তথ্য। ট্রেন থামার পর কয়েকজন যাত্রী সেখানে নেমে পড়েন। এরপরই ঘটে এই ঘটনা। অনেকেরই ধারনা, বিস্ফোরণটি এনজেপি স্টেশনে ঘটনার ছক কষেছিল দুষ্কৃতিরা। রেল কর্তারা জানান, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে সেই বগির সঙ্গে দার্জিলিং মেইলের দুটি স্লিপার কামরা যোগ করার কথা ছিল। তা হলে আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারত।
সে সময়ে সামাজিক মাধ্যমের গুঁতোগুঁতি ছিল না। তাই এই খবর ছড়িয়ে পড়তেও বেশ সময় লেগেছিল। পরদিন কাগজে এই খবর পড়ে সাইকেল নিয়ে বেলাকোবায় ছুটে গিয়েছিলেন অনেকেই। রেডিও এবং জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে এই খবর প্রচার হয়। সরকারি সূত্র বলে, এই বিস্ফোরণের ঘটনায় ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৫৩ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে, বেসরকারি সূত্রে জানা যায়, এতে কম করেও ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৬৬ জন আহত হয়েছেন। এই ঘটনায় কেএলও সংগঠনকে দায়ী করে কয়েকটি সরকারি এবং বেসরকারি সূত্র। যদিও সংশ্লিষ্ট দপ্তর এব্যাপারে স্পষ্ট রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারেনি।
ঘটনার কথা জানতে পেরে সাইকেল নিয়ে বেলাকোবা স্টেশনে ছুটে গিয়েছিলেন অনেকেই। রাতে প্রথমে এলাকাবাসীরা এবং পড়ে রেল পুলিশের একটি দল সারারাত ধরে উদ্ধার কাজ চালিয়েছে। পরদিন সকালে এলাকায় বিশাল পুলিশ বাহিনী, বোম্ব স্কোয়াড, নেতা মন্ত্রীদের আনাগোনা চলে। সেই সন্ধ্যা রাতের দুর্ঘটনার পর কেটে গিয়েছে ১৫ বছর, আজও সেই দৃশ্য মনে করলে শিউরে ওঠেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তাদের কথায়, এই ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শীদের আজীবন শিহরিত করতেই থাকবে।
সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে বিধায়ক খগেশ্বর রায় বলেন, আজও সেই ঘটনা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেই সময়ে আমি রাজগঞ্জ ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি ছিলাম, পার্থ চট্টোপাধ্যায় তৎকালীন সময়ে বিরোধী দলনেতা ছিলেন। তাঁকে ফোন করে খবর জানাই। তিনি পরে আহতদের দেখতে এসেছিলেন। এই ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি। এর পাশাপাশি তিনি আশা করেছেন যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে।
স্থানীয় বাসিন্দা তথা এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মৃত্যুঞ্জয় সেনগুপ্ত জানান, এলাকার অনেকে মিলে উদ্ধার কাজে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম। অন্ধকার কামরা থেকে আহতদের বের করা। তারপর সেখান থেকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া সেই এক না ভোলা অভিজ্ঞতা। ওই ট্রেনে থাকা এক যাত্রী তথা স্থানীয় বাসিন্দা অশোক দাস বলেন, পায়ের অপারেশন হয়েছিল। জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনে বাড়ি ফিরি। প্ল্যাটফর্মে নামার কিছু পরেই এই ঘটনা ঘটে। আতঙ্কে আহত পায়েই বাড়ি ছুটে আসি। ঘটনার তীব্রতায় জ্বরে ভুগেছিলাম।’