কলকাতা: আজ ৪ আগস্ট, কিংবদন্তি শিল্পী কিশোর কুমারের ৯৬তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২৯ সালের এই দিনে মধ্যপ্রদেশের খণ্ডওয়ায় জন্মেছিলেন তিনি। তাঁর আসল নাম ছিল আভাস কুমার গাঙ্গুলী। বাংলা ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি শুধু গায়ক নন, ছিলেন অভিনেতা, পরিচালক, সুরকার, প্রযোজক, এমনকি চিত্রনাট্যকারও। তাঁর জীবন ছিল এক বহুমাত্রিক শিল্পযাত্রা, যেখানে প্রতিটি বাঁকেই ছিল বিস্ময়।
চলচ্চিত্রে তাঁর প্রথম পদার্পণ ঘটে ১৯৪৬ সালে, Shikari ছবির মাধ্যমে। তবে তাঁর মন পড়ে ছিল গানে। ১৯৪৮ সালে Ziddi ছবিতে “Marne Ki Duayen Kyon Mangu” গানটি দিয়ে শুরু হয় তাঁর প্লেব্যাক ক্যারিয়ার। স্বশিক্ষিত এই শিল্পীর গলায় ছিল এক অদ্ভুত স্বাধীনতা—কখনও রোমান্টিক, কখনও হাস্যরসাত্মক, কখনও গভীর দুঃখবোধে ভরা। তাঁর yodelling স্টাইল ছিল একেবারে অনন্য, যা তিনি শিখেছিলেন জিমি রজার্স ও টেক্স মর্টনের গান শুনে।
অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি পরিচালনা করেছেন Door Gagan Ki Chhaon Mein ও Door Ka Raahi—যেখানে তাঁর জীবনদর্শনের ছাপ স্পষ্ট। এই ছবিগুলোর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন, কিশোর কুমার শুধু বিনোদন নয়, ভাবনারও শিল্পী।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চারবার বিবাহ করেছিলেন—রুমা গুহঠাকুরতা, মধুবালা, যোগিতা বালি এবং লীনা চন্দাভারকর। মধুবালার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল গভীর, কিন্তু দুঃখময়। মধুবালার অসুস্থতার সময় তিনি ছিলেন তাঁর পাশে, যত্নে ও ভালোবাসায়।
১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর, মাত্র ৫৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন কিশোর কুমার। তাঁর মৃত্যুর দিনটি ছিল বড় ভাই অশোক কুমারের জন্মদিন। শেষ জীবনে তিনি খণ্ডওয়ায় ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন—যেখানে তাঁর শৈশব কেটেছিল।
তিনি ৮ বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছেন সেরা পুরুষ প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে। তাঁর নামে মধ্যপ্রদেশ সরকার “কিশোর কুমার পুরস্কার” চালু করেছে। আজও তাঁর গান বাজে রেডিওতে, ইউটিউবে, মানুষের হৃদয়ে।
তবে আজকের দিনে তাঁর জীবনের এক বিস্ময়কর অধ্যায় বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য—১৯৭৫ সালে গাওয়া একমাত্র মালায়ালম গান “ABCD Chettan” । Ayodhya ছবির জন্য রেকর্ড করা এই গানটির সুরকার ছিলেন জি দেবরাজন এবং গীতিকার পি ভাস্করণ। গানটি ছিল এক ইংরেজি-ভাষী মালায়ালি ‘চেট্টান’-কে ঘিরে, যার কথায় মিশে ছিল বর্ণমালার ছন্দ, মজার পরিস্থিতি এবং কিশোর কুমারের স্বভাবসিদ্ধ দুষ্টুমি।
যদিও কিশোর কুমার মালায়ালম ভাষা জানতেন না, তিনি গানটি শিখেছিলেন ফনেটিকভাবে—শব্দের উচ্চারণ শুনে মুখস্থ করে। তাঁর কণ্ঠে সেই গান যেন এক শিশুর মতো উচ্ছ্বাসে ভরা, যেন এক অচেনা ভাষার সঙ্গে খেলা করছেন তিনি।
“ABCD Chettan” গানটি কোনও বড় অর্কেস্ট্রা বা গম্ভীর ভাবনার গান নয়। এটি ছিল একেবারে সরল, মজার, এবং কিশোর কুমারের সেই চিরচেনা ‘মিউজিক্যাল প্র্যাঙ্ক’-এর মতো। গানটি দীর্ঘদিন ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল, কিন্তু ইউটিউব যুগে এটি আবার ফিরে এসেছে—নস্টালজিয়ায় ভরা এক বিস্ময় হয়ে।
এই গানটি প্রমাণ করে, কিশোর কুমার ছিলেন ভাষা, ভূগোল বা ঘরানার গণ্ডির বাইরে এক শিল্পী। তিনি শুধু গাইতেন না, গানকে নিয়ে খেলতেন। তাঁর কণ্ঠে ছিল স্বাধীনতা, সাহস, এবং এক অদ্ভুত আনন্দ যা শ্রোতাকে ছুঁয়ে যায়।
হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, গুজরাটি, ওড়িয়া, অসমিয়া, এমনকি মালায়ালম—কিশোর কুমার গেয়েছেন একাধিক ভাষায়। তাঁর কণ্ঠে ছিল কমেডি, রোমান্স, দুঃখ, বিদ্রূপ—সবকিছু। “ABCD Chettan” সেই বহুভাষিক যাত্রার একমাত্র মালায়ালম অধ্যায়, যা আজ তাঁর জন্মদিনে স্মরণ করার মতো।
আজকের দিনে, কিশোর কুমার শুধু এক শিল্পী নন—তিনি এক অনুভূতি, এক ঐতিহ্য, এক অনুপ্রেরণা। তাঁর গান যেমন সময়কে অতিক্রম করে, তেমনই তাঁর জীবনও ছুঁয়ে যায় প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।