ইস্টবেঙ্গল আইএসএল খেলবে, আশাকরি ভবিষ্যতে অনেক সাফল্যও পাবে, কিন্তু শতবর্ষে এসব ঘটনা কাঁটা রুপে ক্লাবের গায়ে লেগে থাকবে।
- দেবজ্যোতি চক্রবর্তী (০৫/০৯/২০)
মঙ্গলবার রাত ১১ টা ৩০ মিনিট। সারাদিনের ক্লান্তির পর ঘুম ঘুম ভাব এসেছে। আচমকা একটা মেসেজ এল মোবাইলে। খুলতেই দেখি কলকাতার সাংবাদিক বন্ধুর মেসেজ। “শ্রী সিমেন্ট কনফার্ম, আগামীকাল নবান্নে ঘোষণা হতে পারে মুখ্যমন্ত্রীর তরফ থেকে”। ঘুমটা ঝট করে কেটে গেল। সকাল হতেই সমস্তটা পরিষ্কার হয়ে গেল। একজন ক্রীড়াসাংবাদিক হিসেবে ভালো লাগছিল লাল হলুদ কর্মকর্তা এবং সমর্থকদের জন্য। এই কমাস কত বিনিদ্র রজনী যাপন করেছেন তাঁরা। বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা হয়ে গেল ইনভেস্টরের নাম। বেনুগোপাল বাঙ্গুরের সংস্থা শ্রী সিমেন্টের হাত ধরেই দেশের সর্বোচ্চ লিগে খেলবে ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু সত্যিই কি কাজটা সহজ ছিল লাল হলুদ কর্মকর্তাদের জন্য? বিগত কয়েকমাস ধরে একটি সংবাদের পেছনে বিস্তর সময় দেওয়ার ফলে বিশেষ কিছু উপলব্ধি হয়েছে। আজ আপনাদের সামনে সেসবই তুলে ধরব।
গত জুলাই মাসে কোয়েসের কাছ থেকে যাবতীয় স্পোর্টিং রাইটস ফিরে পাওয়ার পর ইস্টবেঙ্গল কর্মকর্তাদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল নতুন ইনভেস্টর খোঁজা এবং আইএসএলে এবছরই অংশ নেওয়া। স্পোর্টিং রাইটস ফিরে পেতেও কম কাঠখর পোড়াতে হয়নি কর্মকর্তাদের। সেসব যদিও অনেকেই জানে। জুলাই মাস থেকে শুরু হওয়া লড়াই যে সহজ ছিলোনা সেটা বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন একজন মানুষের কাছে সহজেই বোধগম্য হবে। করোনা কাঁটায় বিদ্ধ দেশের অর্থনীতি। শিল্পক্ষেত্রেও পড়েছে বিশাল প্রভাব। এই পরিস্থিতিতে শ্রী সিমেন্টকে ইনভেস্টর হিসেবে পাওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। এবিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ক্লাবের যে কোর টিম ইনভেস্টরের ব্যাপারে কাজ করছিলেন তাঁদের ভুমিকা অনস্বীকার্য। এছাড়াও এফএসডিএল এবং কিছু বিশেষ ব্যক্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকাও ছিল এই বিশাল কর্মকাণ্ডের পেছনে।
ক্লাবের প্রাক্তন ফুটবলাররা অনেকেই এই কর্মকাণ্ডে কর্মকর্তাদের এবং ক্লাবের পাশে ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা ক্লাবের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। সুভাষ ভৌমিক, আলভিটো ডি কুনহা, গৌতম সরকার, সমরেশ চৌধুরী, সুরজিত সেনগুপ্ত, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ভাস্কর গাঙ্গুলি, সূর্যবিকাশ চক্রবর্তী, সুকুমার সমাজপতি, তরুণ দে, চন্দন দাস, ষষ্ঠী দুলে, দেবজিত ঘোষ ফাল্গুনী দত্ত প্রমুখরা বিভিন্ন সময়ে ক্লাবের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু একটা ব্যাপার দেখে অবাক হয়েছি। বিভিন্ন সময় ক্লাবেরই কিছু প্রাক্তনী মিডিয়ায় এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যা পরোক্ষভাবে ক্লাবেরই ভাবমূর্তিকে নষ্ট করেছে বলে মনে করি। জাতীয় মিডিয়ায় দেওয়া সাক্ষাৎকারগুলো দেখছিলাম। সেখান থেকেই কিছু মন্তব্য চোখে পড়ল।
একটি বাংলা সংবাদপত্রে গতসপ্তাহে প্রাক্তন ফুটবলার শ্যাম থাপা বলেছেন, “মোহনবাগান এটিকে সংযুক্তিকরণ হয়েছে। তাঁরা আইএসএল খেলবে। ইস্টবেঙ্গল এখনও কিছুই করে উঠতে পারল না। সমর্থকরা হতাশ। এসবের জন্য কর্মকর্তারাই দায়ী। কর্মকর্তাদের মাথায় রাখতে হবে যে ঐতিহ্য আর সাপোর্টার বেস দেখিয়ে ব্যাক ডোর কিংবা সাইড ডোর দিয়ে আইএসএলে ঢোকা সম্ভব নয়। আইএসএল খেলার জন্য ৪০ কোটি জোগাড়ের আশা ছেড়েই দিন, আই লিগ খেলতে যে ১১ কোটি টাকার প্রয়োজন, সেটাই জোগাড় করা এখন অসম্ভব।”
এছাড়াও ইস্টবেঙ্গলের ঘরের ছেলে ভাইচুং ভুটিয়ার একটি সাক্ষাৎকার আমার চোখে পড়েছে। বাংলার নামকরা একটি সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভাইচুং বলেছেন, “‘কোয়েস ও ইস্টবেঙ্গলের যা পরিণতি তাতে কর্পোরেট জগতে ভীষণভাবে ক্লাবের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। যা ক্লাবের পক্ষে একেবারেই অভিপ্রেত নয়। ইস্ট বেঙ্গল কর্তাদের ঘরে ও বাইরে মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে ইস্ট বেঙ্গলকে মানিয়ে নিতে হবে। আমি যখন এই ক্লাবে খেলেছি, তখন পরিবেশ একেবারেই ভিন্ন ছিল অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগোক ইস্ট বেঙ্গল। ইস্ট বেঙ্গল ভারতের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। কোনও সন্দেহ নেই, আইএসএল ও ইস্ট বেঙ্গলের একে-অপরকে প্রয়োজন। এখন একটাই প্রশ্ন, কোনও সংস্থা অর্থ বিনিয়োগ করতে চাইলে ক্লাবের বেশিরভাগ শেয়ারই চাইবে। সেটা কি কর্তারা মেনে নেবেন? এর উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে লাল-হলুদের ভবিষ্যৎ।”
ক্লাবের ঘরের ছেলের এহেন বক্তব্য আমাকে স্তম্ভিত করেছে। যদিও এখন ইস্টবেঙ্গলে ভালো সময় এসেছে। কিন্তু কি এমন কারন যাতে কিছু প্রক্তন ফুটবলার ক্লাবের কর্মকর্তাদের নামেই এমন বললেন? ক্লাব কর্মকর্তারা যাদের ইস্টবেঙ্গলের ঘরের ছেলে বলেন, বিভিন্ন কার্যকলাপে সামনে রাখেন, তাঁদের এসব বক্তব্য কর্পোরেট জগতে ক্লাবের ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলতেই পারতো বলে মনে করি।
অপরদিকে বিশেষ কিছু সমর্থকও বিভিন্ন ভাবে ক্লাবের আইএসএল খেলায় ব্যাপারে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। বিগত দিনে বিভিন্ন ইনভেস্টরের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের কথাবার্তা হয়েছে। কিছু ডিল শেষ মুহূর্তে গিয়ে ভেস্তে গিয়েছে। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানা যায় ক্লাবেরই কিছু বিশেষ সমর্থক ইনভেস্টরকে মেইল করে চুক্তি ভেস্তে দেয়। মেইলে লেখা হয় ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্মকর্তারা বেআইনি কার্যকলাপে যুক্ত।
এতসব ‘ব্যাক বাইটের’ পরেও নতুন ইনভেস্টর নিয়ে ইস্টবেঙ্গল আইএসএল খেলবার পথে। ক্লাবের শীর্ষকর্তা ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের এই অসাধ্য সাধন সত্যিই অভাবনীয়। যেসব প্রাক্তন ফুটবলাররা দুর্দিনেও ক্লাবের পাশে ছিলেন, তাঁদের কুর্নিশ অবশ্যই প্রাপ্য। কিন্তু যারা তথাকথিত ঘরের ছেলে হয়েও ক্লাবেরই নামে মিডিয়ায় এসব বললেন এবং যেসব তথাকথিত সমর্থকরা ক্লাবেরই ক্ষতি করলেন?
ইস্টবেঙ্গল আইএসএল খেলবে, আশাকরি ভবিষ্যতে অনেক সাফল্যও পাবে, কিন্তু শতবর্ষে এসব ঘটনা কাঁটা রুপে ক্লাবের গায়ে লেগে থাকবে।