অর্থাভাবকে সঙ্গী করেই PhD! অধ্যাপক হওয়ার লক্ষ্যে রাজগঞ্জের শ্যামল

টানা ২৫ বছর পড়াশোনা করে দেশের একটি স্বনামধন্য কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি লাভ করলেন রাজগঞ্জ সাহাপাড়ার শ্যামল। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে অর্থের যোগান সীমিত থাকায় একটি সীমিত সময়ের জন্যই পড়াশোনার সুযোগ থাকে। সেই দিক থেকে রাজগঞ্জের মতো একটি গ্রামীণ অঞ্চলের জন্য এটি একটি বিরল ঘটনা হিসেবেই ধরে নেওয়া যেতে পারে।

নিম্ন মধ্যবিত্ত সাধারণ পরিবারের ছেলে-মেয়েদের কোনওমতে উচ্চমাধ্যমিক বা কলেজ পেরিয়েই সংসারের হাল ধরতে হয়। বাবা-মায়েদের ইচ্ছে থাকলেও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কথা চিন্তা করে অনেকেই মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তবে নিজের মেধা এবং যোগ্যতার উপর ভরসা করে এতদূর এগিয়ে সাফল্য পেয়েছেন রাজগঞ্জের শ্যামল মোহন্ত। এবার অধ্যাপক হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন তিনি।

বাবার সঙ্গে বাজারে চায়ের দোকান চালিয়ে পড়াশোনা করে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করলেন রাজগঞ্জের সুখানি গ্রাম পঞ্চায়েতের সাহাপাড়ার বাসিন্দা শ্যামা নাথ মোহন্তের বড় ছেলে শ্যামল মোহন্ত। রাজগঞ্জের একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে স্বমহিমায় উঠে এসেছে শ্যামলের নাম। স্বল্প আয়ের পরিবারে দুই ছেলেকে পড়াশোনা করানো সহজ ছিল না বাবা শ্যামা নাথ মোহন্তের।

রাজগঞ্জ বাজারে শ্যামা নাথ মোহন্তের ছোট্ট একটি চা-সিঙ্গারার দোকান রয়েছে। শ্যামল মোহন্তরা দুই ভাই,ছোট ভাই কমল মোহন্তও মাস্টার্স করে দাদার দেখানো পথেই এগোচ্ছেন। এখনও দুই ছেলে বাবার সঙ্গে দোকানের কাজে সাহায্য করেন। রোজ সকালেই খোলা হয় সেই দোকান। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে সেই ব্যবসা সেরকম নেই। এই চায়ের দোকানই শুরু থেকে বাড়ির দুই ছেলের পড়াশোনার পাশাপাশি সংসার চালানোর জন্য অর্থের যোগান দিয়েছে।

ছোটবেলা থেকেই শিক্ষক হওয়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছিলেন শ্যামল। রাজগঞ্জ মহেন্দ্রনাথ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি ২০০৭ সালে মাধ্যমিক এবং ২০০৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর শিলিগুড়ি কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার সুযোগ পান। সে সময়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধার বলেই পড়াশোনা করার সুযোগ পান শ্যামল। তবে ২০১৪ সালে মাস্টার্স শেষ হলে আর্থিক টানাটানির মধ্যে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম হয়। বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার চাপ ছিল। তাছাড়া এতদিন পড়াশোনার পর পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার কথাও ভাবেন শ্যামল। সেসময় বিএড করার ইচ্ছা থাকলেও অর্থের অভাবে তা হয়ে ওঠেনি।

এই অবস্থায় উচ্চশিক্ষার জন্য শেষবারের মত নিজের যোগ্যতার উপর ভরসা করেই ২০১৪ সালে পিএইচডি করার জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন । সেই পরীক্ষায় পাশ করে পিএইচডি করার সুযোগও পেয়ে যান শ্যামল। তার পিএইচডি-র বিষয়বস্তু ছিল বাংলা উপন্যাসে নারীর আত্ম-অন্বেষণ ও জীবন পরিস্থিতির বিবর্তন: প্রফেসর ড. অলকা চট্টোপাধ্যায় এর তত্ত্বাবধানে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে(কেন্দ্রীয়) গবেষণা করেন শ্যামল। ১৯৫০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১০ জন মহিলা ঔপন্যাসিকদের উপন্যাসকে বেছে নেন তিনি। ৫ জুলাই পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন তিনি। এর পাশাপাশি নেট, পশ্চিমবঙ্গ সেট এবং অসম স্লেট পরীক্ষায় পাশ করে আগামীতে শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে অধ্যাপক হওয়ার অন্বেষণে রয়েছেন বলে তিনি জানান।

বাড়ির ছোট ছেলে কমল , বর্তমানে স্নাতক করে পিএইচডি’র চেষ্টা করছে। শ‍্যামলের পিএইচডি করার খবরে খুশি দেবজিত সরকার,স্বপন দেবনাথ,অশোক সাহা প্রমুখ এলাকাবাসীরা। একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের তরফে দীর্ঘ ২৫ বছরের পড়াশোনার জন্য আর্থিক যোগান প্রায় অসম্ভব ছিল। নিজেদের পারিবারিক দোকানে মাঝে মধ্যেই বাবার সঙ্গে তাদেরও হাত বাড়াতে হয়। দোকানে পুরি,সিঙ্গারা ইত্যাদিও তৈরি করতে হয় বলে শ্যামল জানান।

আর্থিক অনটনের সংসারে নিজের বাবা-মার পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা তাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁদের আশীর্বাদ ছাড়া এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা সম্ভব হতো না।

পাশাপাশি বলেন এলাকার পড়ুয়াদের এ ব্যাপারে সাহায্য করার ব্যাপারে তিনি আগ্রহী, তার কথায় গ্রামীণ এলাকায় সকলের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়না। একটা সময়ে যাত্রাপথে প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। একজন উচ্চশিক্ষিত হিসেবে গ্রামের আর পাঁচটা ছেলে-মেয়েকে সাহায্য করার সহজ সুযোগ এলে তিনি অবশ্যই তাদের সহযোগিতা করবেন।

শ্যামলের পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়ার খবরে উৎফুল্ল তার স্কুলের শিক্ষক মহল। রাজগঞ্জ মহেন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক ভূপেন চন্দ্র রায় জানান, শ্যামল ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো তার নামের আগে ডক্টর উপাধি বসেছে। স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা পড়াশোনার ক্ষেত্রে ভালো জায়গায় পৌঁছাতে পারলেই তাঁদের শিক্ষাদানের সার্থকতা আসে। স্কুলের নাম উজ্বল হয়।শ্যামল রাজগঞ্জের উৎসাহী পড়ুয়াদের জন্য অনুপ্রেরণার কাজ করবে।

শ্যামলের বাবা শ্যামা নাথ মোহন্ত ও মা সাবিত্রী (গৃহবধূ) মোহন্ত জানান, তার দুই ছেলে ছোট থেকেই তাদের রাজগঞ্জ বাজারে দোকানের কাজে সাহায্য করত। বর্তমানে বিক্রি-বাট্টা সেরকম হয় না। ছোট থেকে তারা কোন রকমে দিন কাটিয়েছে। ছেলেরা পড়াশোনায় সুনাম ধরে রাখায় পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী তারা। মঙ্গলবার শ্যামল স্থানীয় বিধায়ক মাননীয় খগেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়িতে গিয়ে পিএইচডি ডিগ্রির সফলতার খবর জানাতে গেলে বিধায়ক খুশিতে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং সাফল্যের মিষ্টিমুখ নিজে হাতে করান,পাশাপাশি বলেন শ্যামলের সকল সাহায্যের ক্ষেত্রে তিনি পাশে থাকবেন। তাঁর রাজগঞ্জ বিধানসভা নির্বাচনী এলাকায় অতি নিম্ন পরিবার থেকে এই কৃতিত্ব অর্জন যা বিরল এবং ব্লকের গর্ব।

About The Author

Exit mobile version